হামাস কেন ইসরায়েলে হামলা করলো?

প্রকাশিত: ৯:১২ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১৭, ২০২৩

হামাস কেন ইসরায়েলে হামলা করলো?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
৭ অক্টোবর শনিবার ইসরায়েলের দম্ভ চূর্ণ হওয়ার দিন। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই ইসরায়েলের আকাশে ধুমকেতুর মতো ধেয়ে আসলো হাজার হাজার আলোর রেখা। পরক্ষণেই গর্জে উঠলো আয়রন ডোম। ইসরায়েলিদের বুঝতে বাকি রইলো না হামাসের কাসসাম রকেট এগুলো। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। মাত্র ২০ থেকে ৪০ মিনিটের ব্যবধানে ৫ হাজার রকেটের সবগুলো ধ্বংস করতে পারলো না ‘আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম’। যা হবার তাই হলো! কিছু রকেট তাদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনে জানিয়ে দিলো, ফিলিস্তিনের দখল নিতে হলে প্রথমে হামাসকে মোকাবেলা করতে হবে ইসরায়েলকে। এমন আকস্মিক আক্রমণে পুরো হতবিহ্বল বনে যায় ইসরায়েল। কারণ হামাস এর আগে তো কখনো আগ বাড়িয়ে আক্রমণ করেনি! কেবলই প্রতিরোধ করেছে। তবে এবার কেন? এর সম্ভাব্য কারণগুলোই আজ বিশ্লেষণ করবো।

হামাস-ইসরায়েলের সংঘাত বহু পুরনো। হামাস এতদিন ইসরায়েলের আগ্রাসনের প্রতিরোধ করেছে, কখনো হামাস ইসরায়েলকে হামলা করেনি। এমনকি ২০২১ সালের পর হামাস পুরোপুরি নিশ্চুপ হয়েছিল। চলতি বছর রমজান মাসের তারাবি নামাজের সময় আল-আকসা মসজিদে নামাজরত অবস্থায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের পরও হামাস কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।

ফিলিস্তিনির স্বাধীনাতাকামী সংগঠন হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসিম ব্রিগেডের এত শক্তি নেই যে ইসরায়েলের মতো সামরিক শক্তির দেশে হামলা করবে? কিন্তু হামাস পুরো বিশ্বকে অবাক করে ইসরায়েলে হামলা করে বসেছে। হামাস জানে এই হামলার পর তাদের অধীনে থাকা গাজা হাতছাড়া হতে পারে। সেটাও হামাস হিসেব করেই হামলা করেছে। তাহলে কেন এমন ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত?

হামলা শুরু হওয়ার পরপরই হামাসের মুখপাত্র আল কাদুমি আলজাজিরাকে বলেছেন-“এই হামলা হলো-বিগত দশকজুড়ে ফিলিস্তিনিরা সে নৃশংসতার শিকার হয়েছে তার জবাব। আমরা চাই আন্তর্জাতিক মহল গাজাসহ ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষ ও আল-আকসার মত পবিত্র স্থাপনাগুলোর ওপর হওয়া হামলা বন্ধে সহায়তা করুক- এজন্য এ যুদ্ধ ”।

রয়র্টাস পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- হামাস চায় ফিলিস্তিন ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরে চলা এই খেলাটাকে বদলে দিতে। সত্যিকার অর্থে হামাসের এই আক্রমণ দীর্ঘদিন ধরে চলা ইসরায়েলি আধিপত্যে ভাগ বসিয়েছে। ইসরায়েলের অপরাজেয় যে তকমা ছিল তা যেন হামাসের এবারের আক্রমণে কাঁচের ঘরের মত ভেঙে পড়েছে। যা সপ্তাহ ধরে চলা অপারেশনের ফলাফল দেখলেই আন্দাজ করা যায়। বিগত সময় ইসরায়েলের এত ক্ষয়ক্ষতি কখনো হয়নি। যা হামাসের জন্য কিছুটা জয় বলেই ধরা যায়। কারণ হামাস তাদের ক্ষয়ক্ষতি জেনেই এই অপারেশন চালিয়েছে। এছাড়াও এইমুহূর্তে হামাসের আক্রমণের পেছনে সম্ভাব্য আরও কিছু কারণ আছে বলে ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।

আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ (ইয়ামকিপুর যুদ্ধ):

১৯৭৩ সালের ৬ থেকে ২৫ অক্টোবর আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধ (অক্টোবর যুদ্ধ, রমজান যুদ্ধ ও ইয়ামকিপুর যুদ্ধ বলেও পরিচিত) মিশর ও সিরিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট এবং ইসরায়েলের মধ্যে সংঘটিত হয়। ২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর ইয়ামকিপুর যুদ্ধের ৫০ বছর পূর্ণ হলো, যে যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে নেমে আসে অসহনীয় দুর্ভোগ। প্রতিবছরের এই দিন আরবদের বিপক্ষে বিজয় উপলক্ষে ইসরায়েলে ঘটা করে উদযাপন করা হতো। ইসরায়েলের দম্ভ চূর্ণ করতে ফিলিস্তিনির স্বাধীনাতাকামী সংগঠন হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসিম ব্রিগেড হামলা করে ইসরায়েলকে ভড়কে দেওয়ার জন্য এই দিনটিই বেছে নেয়।

আরব দেশ- ইসরায়েল সম্পর্ক:

সৌদি আরবসহ অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার যে প্রক্রিয়া সম্প্রতি দেখা গেছে, তা হতে পারে এই যুদ্ধের অন্যতম অনুঘটক। কারণ সৌদি আরব ও তার মিত্র দেশগুলোর সমর্থন পেলে ইসরায়েল দেশ হিসেবে মুসলিম বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। সেইসাথে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্নও শেষ হয়ে যাবে। তাই হামাস হয়ত ভেবেছে এখনই সময় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক করে তোলার। আর এমন চলমান একটি যুদ্ধের মাঝে কোন আরব রাষ্ট্রই ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারবে না। ইতিমধ্যেই সৌদি প্রিন্স সালমান ফিলিস্তিনের পক্ষে মতামত দিয়েছেন, মিশর ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়েছে। অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো ফিলিস্তিনের পক্ষে মতামত দিয়েছেন।

রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ:

অনেকের মতে হামাসের এই সময় আক্রমণের পেছনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। ইসরায়েলের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক অস্ত্রের মজুত। যেগুলো তারা ছোট বড় আঞ্চলিক যুদ্ধে ব্যবহার করে। ইসরায়েলও সেগুলো প্রয়োজন মত ব্যবহার করে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে যেসব অস্ত্র সহায়তা দিয়েছেল সেসব অস্ত্রের বেশিরভাগ অস্ত্রই ইসরায়েল থেকে ইউক্রেনে পাঠানো হয়েছিল, ফলে ইসরায়েলের অস্ত্রভাণ্ডার অনেকাংশই খালি হয়ে যায়। এই সুযোগটাই কজে লাগিয়েছে হামাস।

 

 

ইরানের প্রভাব:

অনেকের মতে ইরানের সহায়তার কারণেই হামাস এত সাহস দেখিয়েছে। ইরানের প্রত্যক্ষ মদদেই হামাস তার অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে। ইরানের সহায়তায় অপারেশন আল-আকসা শুরু হয়েছে। কিন্তু কারও কাছে এই বিষয়ে অকাট্য প্রমাণ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্থনি বলেন, অপারেশন আল-আকসায় ইরানের সম্পৃক্ততার অকাট্য কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু ইরান-হামাসের দীর্ঘদিন ধরে সুসম্পর্ক রয়েছে। হামাস কখনো হামাস হয়ে উঠতো না, ইরানের সহায়তা না থাকলে।

রাশিয়া-চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক:

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার সাথে ইসরায়েলের দা-কুমড়া সম্পর্ক। সেকারণে রাশিয়াও যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পাশে আছে। আর চীন বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে শক্ত অবস্থানে আছে। চীন সবসময়ই যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে যারা তাদের পক্ষে থাকে, এটা হামাসকে আরও সাহস যোগাতে সাহায্য করেছে।

অপারেশন আল-আকসা শুরু হয়েছে মাত্র সপ্তাহখানেক। কোনো যুদ্ধ নিয়ে এত তাড়াতাড়ি মন্তব্যও সঠিক নয়, কারণ যুদ্ধ শুরু হলে পরের দিন কি হবে সেটাও ধারণা করা যায় না। বর্তমান পরিস্থিতে ইসরায়েলের আগ্রাসী ভূমিকায় গাজায় মানবিক বিপর্যয় শুরু হয়েছে। এই যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে পুরো বিশ্ব শঙ্কিত। তবে এখন বড় প্রশ্ন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পাশাপাশি হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ বহন করার মত শক্তি-সামর্থ্য সত্যিই এই বিশ্বের আছে?

R/N

আমাদের তথ্যচিত্র গান কবিতা নাটক ভালো লাগলে ফেসবুকে শেয়ার করুন।
0Shares