দাবানলের আগুনে পুড়ছে বিশ্ব, এর জন্য দায়ী কে

প্রকাশিত: ২:৫৮ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ৪, ২০২৩

দাবানলের আগুনে পুড়ছে বিশ্ব, এর জন্য দায়ী কে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :

অস্বাভাবিক তাপ ও গরমে পুড়ছে ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়ার বিশাল অংশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে রুদ্ররূপ ধারণ করেছে বিশ্ব আবহাওয়া। দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে- ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, তুরস্ক, জার্মান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া, কলোরাডো, ওকলাহোমাসহ কয়েকটি শহরে। বহুদেশে তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়েছে।

সাম্প্রতি জাতিসংঘের আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থা ডব্লিউএমও এক সতর্কবার্তা প্রকাশ করে। যেখানে বলা হয়, আগামী পাঁচ বছর এযাবৎকালের সবচেয়ে উষ্ণ সময় পার করতে পারে বিশ্ব। এই সময়ের মধ্যেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে আটকে রাখার যে লক্ষ্য, সেই সীমাও ছাড়িয়ে যেতে পারে।

ডব্লিউএমও বলেছে, ‘আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কমপক্ষে একটি বছর এবং সব মিলিয়ে এই পাঁচ বছর সময়কাল সবচেয়ে উষ্ণ হবে।’ সংস্থাটি বলেছে, ২০২৩-২৭ সালের মধ্যে অন্তত একটি বছরে বিশ্বের ভূপৃষ্ঠের বার্ষিক তাপমাত্রা শিল্পায়নপূর্ব সময়ের চেয়ে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হবে।

এনআইএলইউর দাবানল বিষয়ক গবেষণা পরিচালক জেতিল তোরসেথ বলেন, জলবায়ু সংকটের কারণে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার ফলে দাবানলের ঘটনা আরও বেশি দেখা যাবে এবং দাবানলের মাত্রাও তুলনামূলক বেশি হবে।

এই গবেষক বলেন, ‘আমি মনে করি, দাবানলের মতো এমন ঘটনা ভবিষ্যতে আরও বেশি দেখা যাবে। আর অবশ্যই সেগুলোর প্রভাব জলবায়ুতে পড়বে।’

দাবানল কী
দাবানল হচ্ছে বনভূমি বা গ্রামীণ এলাকার বনাঞ্চলে সংঘটিত একটি অনিয়ন্ত্রিত আগুন। পাহাড়িয়া অঞ্চলে দাবানলের ইন্ধন কিছু বেশি। উষ্ণ তাপক-শিখা ক্রমশ ওপরের দিকে উঠতে থাকে আর পোড়াতে থাকে বন। উঁচু গাছের ক্যানপির আগুন অনায়াসে উড়তে থাকে যত্রতত্র।

অনিয়ন্ত্রিত এই আগুনকে বলা হয় দাবানল। প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে অধিক ঘনত্বের বনে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। দাবানলকে বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের চেয়েও ভয়াবহ দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কেননা বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়া যায় এবং সচেতন থাকলে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু দাবানলের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না।

দাবানল কীভাবে সৃষ্টি হয়
উত্তপ্ত আবহাওয়ায় বনাঞ্চলসমৃদ্ধ যেকোন স্থানেই দাবানল দেখা দিতে পারে। সাধারণত, যখন কোন আগুনের উৎস প্রচণ্ড তাপমাত্রায় এবং যথেষ্ট পরিমাণে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে আসে, তখন দাবানলের সূত্রপাত ঘটে বলেই জানা যায়।

গাছপালা থেকে থেকে ক্রমাগত পানি বাষ্পীভূত হয়ে সৃষ্টি হয় পানির এই ঘাটতি। এই ঘাটতি পূরণ করা হয় মাটি বা বাতাসে বিদ্যমান জলীয় বাষ্প বা বৃষ্টির পানি শোষণ করে। কিন্তু অনেকদিন ধরে উত্তপ্ত ও শুষ্ক আবহাওয়া চলতে থাকলে গাছপালা পানির এই সমতা রক্ষা করতে না পেরে শুষ্ক ও দাহ্য হয়ে ওঠে। যেসব অঞ্চলের আবহাওয়া এতটাই আর্দ্র যে গাছপালা দ্রুত বৃদ্ধি পায়, আবার দীর্ঘ সময়ের জন্য শুষ্ক ও উষ্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে, সেসব অঞ্চলে দাবানল ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।

আমেরিকার বনাঞ্চলে বিভিন্ন উপায়ে আগুন লাগে বছরে প্রায় এক লক্ষ বার। যে কারণে পুড়ে যায় ২০ লক্ষ হেক্টর জমি। ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম এই আগুন সামনে যা কিছু পায় পুড়িয়ে নিঃশেষ করে গাছপালা, ঘরবাড়িসহ মানুষসহ।

সম্প্রতি ২০১৩ সাল থেকে এই পর্যন্ত প্রকাশিত প্রায় ১০০টি গবেষণার আলোকে তৈরি নতুন এক পর্যালোচনা প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়নের ফলে ক্রমবর্ধমান উষ্ণ এবং শুষ্কাবস্থার ওপর জলবায়ুর প্রাকৃতিক পরিবর্তনশীলতা চেপে বসলে চরম অগ্নিকাণ্ড ঘটে। যুক্তরাজ্যের ইস্ট অ্যাঙ্গিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাথু জোন্স বলেন, গত দশকগুলোর চেয়ে চলতি দশকে আগুন লাগার প্রবণতা ৮ থেকে ১০ গুণ বেড়ে গেছে।

উষ্ণতার কারণে আমাদের পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। কয়েক দশক ধরে বন উজাড় হওয়ার কারণে পরিবেশের ক্ষতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, পৃথিবীর পরিবেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। গাছ দিয়ে ঢেকে থাকা পৃথিবী এখন গাছের অভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কড়াল গ্রাসে ধরা দিয়েছে।

গাছ কাটাই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মূল এবং প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন দিন জলবায়ু আরও বিপর্যয়ের মুখে চলে যাচ্ছে গাছ কমতে থাকায়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রতি বছর যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড আছে, তার দুই তৃতীয়াংশ শোষণ করে নেয় গাছ। পৃথিবীর চারপাশের বন কমতে থাকায় পৃথিবীর প্রতিরোধক্ষমতাও কমে যাচ্ছে।

দাবদাহ, অনাবৃষ্টি, খরা, বজ্রপাত, আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত এবং এলনিনো ধরনের আবহাওয়ার চক্রাকার পরিবর্তনকে জঙ্গলে আগুন লাগার প্রাকৃতিক কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

মূলত, সংঘটিত দাবানলের ১০টির মধ্যে আটটির পেছনেই মানব সৃষ্ট কোনো না কোনো কারণ কাজ করে বলে গবেষকরা বলছেন। এসব কারণের মধ্যে সিগারেট বা ক্যাম্প ফায়ার, চাষাবাদযোগ্য জমি বৃদ্ধি বা নগরায়ণের লক্ষ্যে আগুন লাগানোর সময় দুর্ঘটনাবশত তা ছড়িয়ে পড়া প্রধান।

বাংলাদেশে দাবানলের সম্ভবনা
বাংলাদেশে সাধারণত দাবানলের ঘটনা কমই ঘটে। যা ঘটে তাকে ঠিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলা যায় না। দুর্ঘটনা বা মানুষের অসাবধানতাই এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী। তবে বাংলাদেশে দাবানলের সম্ভবনা না থাকলেও দাবানলের প্রভাব থাকছেই। বাড়বে গড় তাপমাত্রাসহ গরমের প্রভাব। আমেরিকা, ক্যালিফোর্নিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই দাবানলের ঘটনা ঘটে। এর ফলে বৃক্ষসম্পদ নষ্ট হয়। নষ্ট হয় জীববৈচিত্র্য। যার প্রভার পড়বে পুরো পৃথিবীজুড়ে। ব্যতিক্রম হবে না বাংলাদেশও।

দাবানলের আগুন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। বিগত এক দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বড় পরিসরে অনেকগুলো দাবানলের ঘটনা ঘটে গেছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালের মধ্যভাগ থেকে শুরু হয়ে শেষভাগ পর্যন্ত চলা ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানলের ঘটনাটি স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ দুর্যোগ এবং ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দাবানল। সে বছর ক্যালিফোর্নিয়ায় বিচ্ছিন্নভাবে প্রায় সাড়ে আট হাজারেরও বেশি দাবানলের ঘটনা ঘটেছে এবং শেষ পর্যন্ত সেগুলো বিভিন্ন স্থানে মিলিত হয়ে বড় আকার ধারণ করেছে। ফলে প্রায় পুরো বছরই মার্কিন সরকারকে এই দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে।

এ দাবানলগুলো প্রায় আট হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রায় ৮৫ জন মানুষ নিহত হয়েছিল এবং ক্ষয়-ক্ষতির হিসাবটা প্রাথমিকভাবেই ৩.৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

R/N

আমাদের তথ্যচিত্র গান কবিতা নাটক ভালো লাগলে ফেসবুকে শেয়ার করুন।
0Shares