প্রলোভন বা পেশিশক্তির কাছে বিচারক মাথা নত করতে পারে না: প্রধান বিচারপতি

প্রকাশিত: ৭:৫০ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪

প্রলোভন বা পেশিশক্তির কাছে বিচারক মাথা নত করতে পারে না: প্রধান বিচারপতি

জাতীয় ডেস্ক:

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, বিচার বিভাগের দায়িত্ব হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে আইন অনুসারে বিরোধ মীমাংসা করা। বিচারক দেশের প্রচলিত আইন ও শুধু নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। কোনো প্রলোভন বা পেশিশক্তির কাছে বিচারক কখনো মাথা নত করতে পারেন না। এটাই সর্বজন স্বীকৃত বিচার বিভাগের কর্মের মানদণ্ড।

শনিবার ( ২১ সেপ্টেম্বর ) অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে দেওয়া অভিভাষণে এসব কথা বলেন প্রধান বিচারপতি।

সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের ইনার গার্ডেনে এই অভিভাষণের আয়োজন করা হয়। এ সময় অধস্তন আদালতের বিচারক ছাড়াও সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিরা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। অনুষ্ঠানের শুরুতেই জুলাই–আগস্টের শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

প্রধান বিচারপতি পৃথক সচিবালয়ের বিষয়ে বলেন, ‘বিচারকদের নিয়োগ, কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, বরখাস্তকরণ, শৃঙ্খলা বিধান ইত্যাদি–সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত যেসব বিধিমালা প্রচলিত রয়েছে, সেগুলোতে প্রদত্ত “উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ”–এর সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সচিবকে অন্তর্ভুক্ত করলেই বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পথে আইনগত কোনো বাধা থাকবে না।

‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ন্যায়বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তাব প্রস্তুতক্রমে আমরা শিগগিরই আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করব।’

তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পর বিচার বিভাগে গুণগত পরিবর্তন আনয়নে আমার অন্যতম কাজ হবে বিচারকদের যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়ন নিশ্চিত করা। যাতে বিচার বিভাগ পূর্বের শাসনামলের মতো ভীতু ও আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে না পারে।

‘বর্তমানে বিচারকদের পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই। ফলে পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনেক সময়ই বিচারকেরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। আমি এ বিষয়ে একটি যথোপযুক্ত নীতিমালা দ্রুত প্রণয়ন করব।’

উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা হিসেবে সংবিধানের ৯৫ (২) অনুচ্ছেদে যে বিধান রয়েছে, কেবল সেটুকু নিশ্চিত করে নিয়োগের ফলে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হিসেবে পালন করেছে। এটি ন্যায়বিচারের ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।

তিনি বলেন, ‘বিচারকগণ যে গুরুদায়িত্ব পালন করেন, তা রাষ্ট্র কাঠামোর ভিত্তি মজবুত করতে সহায়তা করে। আমাদের বুঝতে হবে যে একজন সহকারী জজের আদেশও প্রজাতন্ত্রের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী মানতে বাধ্য। কেননা, বিচারকগণ রাষ্ট্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতার প্রয়োগ করে থাকেন। তাই বিচারকদের যদি প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর তুলনায় যথাযথ মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা না দেওয়া হয়, তা একধরনের বৈষম্য তৈরি করে।’

বর্তমানে অতিরিক্ত জেলা জজ পদমর্যাদার নিম্নে কোনো বিচারকের জন্য পৃথক গাড়ি নেই। মাঠপর্যায়ে বিচার বিভাগের কার্যকর পৃথকীকরণ নিশ্চিতকল্পে বিচারকদের পৃথক আবাসন, পরিবহন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।

মামলাজটের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মামলাজট বিচার বিভাগের একটি বড় সমস্যা হিসেবে সব আমলেই চিহ্নিত হয়ে এসেছে। মুদ্রার অন্য পিঠে আছে স্বল্পসংখ্যক লোকবল, এজলাস সংকট তথা অবকাঠামোগত অসুবিধাসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতা। মামলাজটের অন্যতম কারণ হচ্ছে, মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যার অপ্রতুলতা। এ ছাড়া একজন বিচারক একই সঙ্গে একাধিক আদালত ও ট্রাইব্যুনালের দায়িত্বে থাকেন। তা বিলোপ করে একজন বিচারককে একটি আদালতের দায়িত্ব প্রদান করতে হবে।

‘এ জন্য আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে হবে। সংস্কার প্রক্রিয়ার শুরুতে এখন অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমেও এটা করা সম্ভব। এসব বিষয়ে আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করছি।’

ফৌজদারি মামলার বিষয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ফৌজদারি মামলার তদন্তকাজ যেন দীর্ঘদিন ঝুলে না থাকে, পুলিশকে সে ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের তদন্ত রিপোর্ট প্রদানের জন্য ইতিমধ্যে ১১১ বার সময় নেওয়া হয়েছে। এটা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। কেননা, সময়ের আবর্তে মামলার অনেক সাক্ষী ও সাক্ষ্য হারিয়ে যায়। বিচার বিভাগকে ডিজিটাইজড করার জন্য দ্রুত ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বিচারকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং বিচার বিভাগে দুর্নীতি বন্ধ করতে আমি বদ্ধপরিকর। বিচার বিভাগে যেকোনো প্রকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করছি। আমাদের মনে রাখতে হবে, ব্যক্তি পর্যায়ে একজন বিচারকের দুর্নীতি সমগ্র বিচার বিভাগের ওপরেই কালিমা লেপন করে। এমনকি আদালতের একজন সহায়ক কর্মচারী কিংবা আইনজীবী সহকারীও যদি দুর্নীতি করেন, সাধারণ জনগণ সাদা চোখে সেটিকে বিচার বিভাগের অবক্ষয় হিসেবেই গণ্য করে।’

যদি দুর্নীতি প্রতিরোধে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কোনো প্রতিষ্ঠানপ্রধান বা দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক ব্যর্থ হন, তবে সেটিকে তাঁর পেশাগত অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

আমাদের তথ্যচিত্র গান কবিতা নাটক ভালো লাগলে ফেসবুকে শেয়ার করুন।
0Shares