৮ মাস ধরে বেতন নেই, মানবেতর জীবন রাজশাহীর সাকোয়াটেক্সের শ্রমিকদের

প্রকাশিত: ৩:৩০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৮, ২০২৪

৮ মাস ধরে বেতন নেই, মানবেতর জীবন রাজশাহীর সাকোয়াটেক্সের শ্রমিকদের

জাতীয় ডেস্ক:

কেউ তিন মাস, কেউ আট মাস ধরে বেতন পাননি। তাই দিতে পারেননি বাড়ি ভাড়া, দোকানে ভরেছে বাকির খাতা। কারও কারও সন্তানের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অসুখ-বিসুখে কেউ নিজের চিকিৎসাটা পর্যন্ত করতে পারছেন না। বেতন না পেয়ে এ রকম বিপদে পড়েছেন রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সদ্য সাবেক এমপি এনামুল হকের সোয়েটার কারখানা সাকোয়াটেক্সের প্রায় ৩০০ শ্রমিক

অবশেষে বেতন আদায়ে গতকাল বুধবার সকাল ৮টা থেকে কারখানার ভেতরে অনশন শুরু করেছেন শ্রমিকেরা। সারা রাত তারা কারখানার ভেতরেই ছিলেন।

বৃহস্পতিবার ( ১৮ জানুয়ারি ) দুপুর পর্যন্ত তারা ভেতরেই অবস্থান করে বিক্ষোভ করছিলেন।

রাজশাহী নগরীর বিসিক শিল্পনগরীতে অবস্থিত সাকোয়াটেক্স নামের এই কারখানাটি। এটি তিনবারের সাবেক এমপি এনামুল হকের এনা গ্রুপের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। বর্তমানে প্রায় ৩০০ শ্রমিক কর্মরত আছেন এই সোয়েটার কারখানায়। সবার বেতন বকেয়া পড়েছে।

কারখানার লিংকিং অপারেটর আশা বেগম বলেন, ‘এখানে শ্রমিকেরা উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে পারিশ্রমিক পান। মাসে গড়ে তারা ১৭ হাজার টাকা করে বেতন পান। কারখানার ২০০ শ্রমিকের কেউ সর্বনিম্ন তিন মাস এবং সর্বোচ্চ আট মাসের বেতন পাবেন। আমি নিজে পাব চার মাসের বেতন। প্রতি মাসে বেতন না পাওয়ার কারণে বাড়িভাড়া বাকি পড়েছে। দোকানে অনেক টাকা বাকি পড়েছে। এখন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারছি না। নতুন বছরে বাচ্চাদের স্কুলড্রেস করে দেওয়ার মতো টাকাও নেই। খুব বিপদে আছি।’

সম্পা খাতুন নামের আরেক নারী শ্রমিক বলেন, ‘কেউ বেতন চাইতে গেলে কারখানার কর্মকর্তারা দুর্ব্যবহার করে। যারা বেতন চায়, তাদের নামের তালিকা করা হয়। এর পরদিন থেকে গেট দিয়ে আর ওই শ্রমিকদের কারখানায় ঢুকতে দেওয়া হয় না। এভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। সম্প্রতি এভাবে ১৫ থেকে ২০ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এবার আমরা এক জোট হয়ে আন্দোলন শুরু করেছি। আমাদের আর চাকরির দরকার নাই, বেতনের দরকার।’

সেলিনা বেগম নামের আরেক নারী কর্মী বলেন, ‘বেতন চাইতে গেলে জোর করে সাদা কাগজে সই নেয়। বলে, এটা রিজাইনের কাগজ। বেতন দিয়ে দেবে। তারপর বাইর করে দেয়। ওই বেতন আর দেয় না। তিন মাসের বেতনও মেরে খেয়ে নেয়। গত ঈদেও আমার এতিম বাচ্চাকে নিয়ে খালিমুখে কাটিয়েছি। বেতন দেয়নি। এখানে কাজ করে শ্রমিকদের এই অবস্থা।’

কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন পিয়ারা বেগম নামের এক নারী শ্রমিক। তিনি বলেন, ‘আমি আর আমার ছেলে তুষার এখানে কাজ করি। তিন মাস-চার মাস হয়ে যাচ্ছে বেতন বন্ধ। দুই মা-ব্যাটারই বেতন বন্ধ। আমরা চলব কী করে? এই দুঃখের কথা তো কাউকে বলা যায় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই ভোটের সময় বেতন চাইতে গেলে বলল, মালিক (এনামুল হক) নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। ভোট পার হলে বেতন দেবে। ভোটে তিনি হেরে গেছেন। বেতনের খবর নাই।’

শ্রমিকদের অভিযোগ, কারখানায় তারা বেতনের দাবিতে অবস্থান নিলে পুলিশ আসে। কিন্তু তারা কারখানার পক্ষ নিয়েই কথা বলে। অবস্থান নিলে লাঠিপেটা করে বের করে দেওয়ার হুমকি দেয়।

এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে এক শ্রমিক বলেন, ‘মালিকের অনেক টাকা আছে, তাই পুলিশ তাদেরই পক্ষ নেয়। আমাদের টাকা নেই, তারা আমাদের লাঠিপেটা করতে চায়।’

শ্রমিকেরা জানান, তিন-চার মাস ধরেই প্রতি সপ্তাহে বেতন পরিশোধের আশ্বাস দেওয়া হয়। সপ্তাহে সোমবার কিংবা বৃহস্পতিবার বেতন দেওয়া হবে বলে কর্মকর্তারা জানান। কিন্তু বেতন দেওয়া হয় না। মাসের পর মাস তারা এভাবে বেতন ছাড়া মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।

শ্রমিকেরা যখন এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন সেখানে আসেন আইটি ইনচার্জ মো. শামীম। তিনি বলেন, বিকেলের মধ্যে বেতন দিয়ে দেওয়া হবে। শ্রমিকদের এসব কথা যেন প্রচার করা না হয়।

এ সময় শ্রমিকদের তোপের মুখে পড়েন শামীম। শ্রমিকেরা বলেন, প্রতি সপ্তাহে দুই দিন তাদের বেতন পরিশোধ করা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বেতন দেওয়া হয় না।

এ সময় শামীম বলেন, ‘বাংলাদেশের কারখানায় এমনই হয়।’

শ্রমিকেরা তিন থেকে আট মাসের বেতন বকেয়া থাকার কথা বললেও এনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাবেক এমপি এনামুল হক বলেন, ‘শ্রমিকদের মাত্র এক মাসের বেতন বাকি আছে। সম্প্রতি কারখানার সোয়েটার রপ্তানি নিয়ে একটু ঝামেলা হওয়ায় শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করা যায়নি। আজ বিকেলের মধ্যেই শ্রমিকদের বেতন দিয়ে দেওয়া হবে।’

আমাদের তথ্যচিত্র গান কবিতা নাটক ভালো লাগলে ফেসবুকে শেয়ার করুন।